সুকৌশলে দেহবাদী আক্বীদা যারা প্রবেশ করালো ইসলাম ধর্মের মধ্যে

মুসলমানদেরকে তাদের মৌলিকত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের মতো বানিয়ে দেয়ার জন্য দু’টি কাজ ছিলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এমন আকিদা – বিশ্বাস প্রচার করা যা আল্লাহর সম্পর্কে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের আকিদা – বিশ্বাসের সাথে বড় ধরণের কোন বিরোধ না থাকে। সেই হিসেবে সুকৌশলে মুসলমানদের মাঝে দেহবাদী আকিদার ব্যাপক বিস্তার ছিলো তাদের প্রাথমিক কাজ। আরেকটি বড় কাজ ছিলো, নবীজীর থেকে উম্মতের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। এর জন্য নবীজীর আজমত ও মহব্বত প্রকাশ পায় এমন সব কাজকে হারাম, নাজায়েজ, শিরক, বিদয়াত ইত্যাদি হিসেবে তুলে ধরা। এর মধ্যে নবীজীর ওসিলাকে শিরক বানান, তার কবর জিয়ারতকে হারাম বলা, তার স্মরণে কৃত মিলাদ-মাহফিলকে সবচেয়ে বড় বিদয়াত বা নিকৃষ্ট বিদয়াত বলা থেকে শুরু হয়। এই পর্যায়ের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হলে নবীজীকে নানাভাবে খাটো করা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার রাস্তা তৈরি করা হয়। এগুলো এক দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া হিসেবে চলমান আছে। মুসলমানদেরকে সার্বিকভাবে দুর্বল করতে এবং ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের কাছাকাছি নিতে এটি ছিলো কার্যকর পদ্ধতি। আর এই সবই করা হয়েছে ইসলামের বিশুদ্ধবাদিতার দাওয়াতে। শিরক থেকে মুক্ত হওয়ার দাওয়াত দিয়ে দেহবাদী বানিয়ে আরও বড় শিরকের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নবীজীর বিষয়ে শিরক থেকে বাঁচার দাওয়াত দিয়ে নবীজীর প্রতি সব-ধরণের আজমত নষ্ট করে তাঁকে খাটো করার বিভিন্ন সবক শেখান হয়েছে। এভাবে সবচেয়ে ভালো কথা বলে সুফাহাউল আহলামরা সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজগুলো করে আসছে উম্মতের সাথে।

হিন্দুস্তানে ব্যাপকভাবে খ্রিষ্টান মিশনারীরা যখন কাজ শুরু করে তখন তারা নবীজীকে তাদের টার্গেট বানায়। নানাভাবে নবীজীর ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা থেকে শুরু করে মুসলমানদের মাঝে বিদ্যমান নবীজীর আজমত সংক্রান্ত আমলগুলো থেকে বিমুখ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। বিভিন্ন জায়গায় তারা সভা-সেমিনার করতে থাকে। ইসলামের উপর নানা আপত্তি সমাজে ছড়াতে থাকে। পাদ্রী ও মিশনারিদের এই হীন ষড়যন্ত্রের বিষয়ে হিন্দুস্তানে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানবী রহ:। তার অদ্বিতীয় গ্রন্থ ইজহারে হক্ব এখনও পর্যন্ত পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে সর্বমহলে সমাদৃত একটি কিতাব। খ্রিষ্টানদের সাথে বাহাস, তাদের বিরুদ্ধে কিতাবাদি রচনার অভিজ্ঞতা থেকে কিরানবী রহ: গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় লিখেছেন। এগুলো আমাদের জানা দরকার। নিচে ‘আনোয়ারে সাতিয়া’ কিতাবে রহমাতুল্লাহ কিরানবী রহ: এর বক্তব্যের অনুবাদ তুলে ধরছি।

রহমাতুল্লাহ কিরানবী রহ: আনোয়ারে সাতিয়া কিতাবে তার প্রশংসাবাণীতে লিখেছেন,

“আনোয়ারে সাতিয়া নামক কিতাবটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি ভালোভাবে শুনেছি। উত্তম বর্ণনাভঙ্গি ও সাবলীল উপস্থাপনা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। কিতাবের প্রশংসায় যদি কিছু লিখি, তাহলে মানুষ সেটাকে অতিরঞ্জন হিসেবে নিবে। এজন্য কিতাব সম্পর্কে প্রশংসা না করে দু’য়াকেই যথেষ্ট মনে করছি। আল্লাহ তায়ালা যেন লেখককে অফুরন্ত সওয়াব ও অতি উত্তম বদলা দান করেন। এই পুস্তকরে মাধ্যমে মিলাদ বিরোধীদের গোঁড়ামীপনাকে ভেঙে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। এবং লেখকের ইলম, ফয়েজ ও সুস্থতায় আল্লাহ তায়ালা বরকত দান করুন।

পবিত্র মিলাদ সম্পর্কে আমার ও আমার উস্তাগণের পূর্ব থেকেই এই বিশ্বাস ছিলো এবং এখনও আছে বরং সত্য কসম খেয়ে এটা বলা যায় যে, আমার ইচ্ছা হলো, (ফার্সী কবিতার অনুবাদ) এর উপরই জীবন কাটিয়েছি, এর উপরই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চাই।

এ বিষয়ে আমাদের আকিদা হলো,
মিলাদের মজলিশ যদি বিভিন্ন ধরণের শরীয়াত বিরোধী কর্মকান্ড যেমন, গান-বাজনা এবং অনর্থক অতিরিক্ত আলোক-সজ্জা না হয় এবং বিশুদ্ধ বর্ণনার আলোকে নবীজীর মু’জিজা ও তার জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়, এরপর পাকান খাবার বা শিরনিও যদি দেয়া হয়, তাহলে এধরণের মিলাদ করতে কোন সমস্যা নেই। বরং বর্তমান সময়ে চারিদিকে পাদ্রীরা যেভাবে শোরগোল শুরু করেছে, বাজারে বাজারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার দ্বীনকে নিন্দা-মন্দ বলা শুরু করেছে, অন্যদিকে আরিয়া সমাজ পাদ্রীদের মতো বা তাদের চেয়ে বেশি হাঙ্গামা শুরু করেছে, এ পরিস্থিতে উপরে উল্লেখি শর্ত অনুযায়ী এধরণের মিলাদ মাহফিল করা ফরজে কিফায়া। আমি মুসলিম ভাইদেরকে নসীহাত হিসেবে বলছি, এধরণের মাহফিল করা থেকে বিরত হবেন না। এবং যারা গোঁড়ামী বশত: এগুলোর বিরোধিতা করে তাদের প্রতি কখনও ভ্রুক্ষেপ করবেন না। মিলাদের দিন নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে যদি এই আকিদা না থাকে যে, ওই দিন ছাড়া অন্য দিন জায়েজ নেই, তাহলে এভাবে দিন নির্ধারণে কোন শরয়ী সমস্যা নেই। এধরণের দিন নির্ধারণের বৈধতা শরীয়াতে খুব ভালোভাবে প্রমাণিত। আর মিলাদে ক্বিয়ামের বিষয়টি তো ৬ শ’ বছর ধরে মুসলমানদের মাঝে চলে আসছে। অধিকাংশ নেককার উলামায়ে কেরাম যেমন, কালামের উলামায়ে কেরাম, সুফিয়া কেরাম ও মুহাদ্দিসগণ একে জায়েজ বলেন। এ বিষয়ে বক্ষমান কিতাবের লেখকও বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।

ঐ সমস্ত বিরোধীদের ব্যাপারে আশ্চর্যন্বিত হতে হয়, তারা বিরোধিতার ক্ষেত্রে এতো বেশি অগ্রসর হয়েছে যে, তারা মরক্কোর এক আলিম ফাকিহানীর মুকাল্লিদ হয়ে তারা জমহুর সালাফে সালেহীন যাদের মধ্যে মুতাকাল্লিমীন, মুহাদ্দিসীন ও সুফিয়া কেরাম রয়েছেন, তাদের সবাইকে মুহূর্তে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছেন। তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও অন্যদের পথভ্রষ্টকারী বানিয়ে দিয়েছে। তারা আল্লাহকে এতটুকু ভয় করেনি যে, এই কাতারে তাদের উস্তাদগণ ও পীরও রয়েছে। যেমন, শাহ আব্দুর রহীম দেহলভী রহ:, শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ:, তার পুত্র শাহ আব্দুল কাদির রহ, তার ভাই শাহ আব্দুল আজিজ রহ:, তার নাতী শাহ ইসহাক রহ:। তাদের সবাই এই দ্বাল ও মুদ্বিল ( নিজে পথভ্রষ্ট ও অন্যকে পথভ্রষ্টকারী) এর কাতারে শামিল হয়ে যায়। এধরণের হঠকারিতার উপর আফসোস, যার কারণে জমহুর মুতাকাল্লিমীন, হারামাইন, মিশর, শাম, ইয়ামানের সূফিয়া কেরাম ও মুহাদ্দিসীন এবং অন্যান্য দেশের লাখ লাখ লোক সবাই গোমরাহ হবে আর হাতে গোনা এই কয়জন লোক হিদায়াতের উপর? হে আল্লাহ আমাদেরকে ও তাদেরকে হেদায়াত দান করুন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন।

আর যারা আমার নামে একথা প্রচার করে যে, আরবদের ভয়ে আমি আসল বিষয় প্রকাশ করি না বরং চুপ থাকি, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। বরং এটি তাদের প্রপাগান্ডা। আমি কসম দিয়ে বলছি, আমি সুলতানের সামনে (সেই সময়ের তুর্কি খলিফা) কখনও তার বা তার সভাসদের মর্জির জন্য অবাস্তব বা শরীয়াত বিরোধী কিছু কখনও বলিনি। বরং যেই দু’বার আমাকে ডাকা হয়েছে, প্রত্যেক বারই স্পষ্ট কথা বলেছি। কখনও এটি খিয়াল করিনি যে, সুলতান বা তার সভাসদ আমার উপর নাখোশ হবে। উসমান নূরী বাদশাহর সাথে আমার যে বিরোধ হয়েছিল এবং তার সভাসদে আমার সাথে যেই কথোপকথন হয়েছিল, এটি তো হেজাজের বিশেষ করে হারামাইনের ছোট-বড় সবাই ভালো করে জানে। যদি আমার তাকিয়া করার কিছু থাকত, তাহলে এই সব মিলাদ বিরোধীদের থেকে তাকিয়া করার দরকার ছিলো। আমার মোটামুটি ইয়াকীন আছে যে, এদের হাত থেকে ইমাম সুবকী, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, ইবনে হাজার এবং অন্যান্য হাজার হাজার মুত্তাকী উলামায়ে কেরাম, বিশেষ করে তাদের উস্তাদ ও পীরের সিলসিলায় হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও অন্যরা যখন বাঁচেনি, আমি নগন্য বান্দা কীভাবে বাঁচব? এরা সব ধরণের তাফসীক ( খারাপ গালাগালি, বিদয়াতি ইত্যাদি বলা) করবে বরং তাকফির (কাফের বলা) করতেও কুন্ঠিত হবে না। কিন্তু আমি তাদের এই ঘৃণ্য কর্মকান্ডকে ভয় পাই না। আমার এই অবস্থানের পক্ষে দলিল হিসেবে বক্ষমান গ্রন্থের লেখক যা তুলে ধরেছেন সেগুলোকে গ্রহণযোগ্য ও যথেষ্ট মনে করি। “

  • রহমাতুল্লাহ বিন খলিলুর রহমান।

প্রিয় পাঠক, উপরের আলোচনা থেকে আশা করি পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা নিস্প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা সুন্নত প্রতিষ্ঠা বা নিজেদের ভুল বুঝের উপর প্রতিষ্ঠিত বিদয়াত বিরোধিতার নামে সমাজে ফেতনা করা থেকে হেফাজত করুন।

সূত্র:
আনোয়ারে সাতিয়া
লেখক: আব্দুস সামী রামপুরী (হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ: এর খলিফা) পৃষ্ঠা: ৪০৯-৪১০

লিখকের প্রোফাইল লিংকঃ- (সকলে এড হোন)
https://www.facebook.com/hm.ijhar

Author: mehedihassan2017

I m a Muslim (sunni)

Leave a comment